ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন ঝুলন গোস্বামী, বল গার্ল থেকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যাত্রা

লর্ডসে ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার তৃতীয় ও শেষ ওডিআইয়ে ভারতের সিনিয়র খেলোয়াড় ঝুলন গোস্বামী অর্থাৎ চাকদা এক্সপ্রেস তার ক্যারিয়ারে শেষবারের মতো মাঠে নেমেছিলেন।

ঝুলন গোস্বামী যখন ব্যাট করতে নামেন, তখন ভারত ও ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁকে ‘গার্ড অব অনার’ দেন। দর্শকরাও হাততালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান।

১৬ রানে ম্যাচ জিতে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছে ভারত। একই সঙ্গে ঝুলন তার শেষ ম্যাচে ২ উইকেট নেন।

ইডেন গার্ডেন্সের সেই বল গার্ল
ইডেন গার্ডেনস, ভারতের ক্রিকেটের তীর্থভূমি। ১৯৯৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর মাঠে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল। একের পর এক চার-ছক্কা মারছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বেলিন্ডা ক্লার্ক।

একই ফাইনাল ম্যাচে ১৫ বছর বয়সী এক ভারতীয় মেয়েও ছিল, যে বাংলার একটি গ্রাম থেকে এসেছিল এবং বল গার্লে ডিউটিতে ছিল। বিশ্বকাপের ঝলকানি আর মহিলা ক্রিকেটের মহারথীদের দেখে সেই তরুণীর চোখেও নতুন স্বপ্ন লালিত হয়ে গিয়েছিল— এক দিন বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন।

ঝুলন গোস্বামী নামে ওই মেয়েটির জীবন চিরতরে বদলে দিয়েছিল এই মুহূর্ত।

২০ বছরের দীর্ঘ কেরিয়ারের পর আজ যখন তিনি অবসর পাচ্ছেন, সেই ঝুলন গোস্বামীকেই বিশ্বের সেরা মহিলা ক্রিকেটারদের মধ্যে
একজন বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। লর্ডসের মাঠে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পর ঝুলনের নামের পাশে এখন ২৫৫টি উইকেট রয়েছে।

তার প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে ঝুলন বলেন, “আমি বাংলার একটি ছোট গ্রাম চাকদায় বড় হয়েছি। উঠোনে বাড়ির ছেলেরা সবাই ক্রিকেট খেলত, যেমনটা প্রায়ই গ্রামে হয়। আমি তাদের বল গার্ল ছিলাম যার কাজ ছিল উঠোনের বাইরে যাওয়া বলটি তুলে নিয়ে ভাইদের দেওয়া। যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, তখন আমি একা একা অনুশীলন করতাম।

‘আমার বয়স তখন দশ বছর। আমার মনে আছে, ১৯৯২ সালের পুরুষদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ টিভিতে দেখেছিলাম এবং হঠাৎ করেই ক্রিকেটের প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। আমার এখনও মনে আছে শচীন স্যারকে টিভিতে খেলতে দেখেছিলাম। সেই সচিন-সচিন কণ্ঠস্বর। এরপর বিশ্বকাপের প্রচারে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। আমাদের বয়সের শিশুরা খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিল”।

তবে ঝুলনকেও তাদের সাথে খেলতে দেওয়ার জন্য গ্রামের ছেলেদের বোঝানো সহজ ছিল না। ঝুলন স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘ছেলেরা বলত, আমি স্লোয়ার বল করি। এছাড়াও, যদি তাদের চোখে জায়গা করে নিতে হয় তবে আপনাকে অল-রাউন্ডার হতে হবে। তাই আমি নিজেও এই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম যেন আমি দ্রুত বোলিং করতে পারি।

কিন্তু গ্রামে কোনও সুবিধা ছিল না, কোচিংও ছিল না, তাই প্রতিদিনই গ্রাম থেকে কলকাতায় প্রশিক্ষণের জন্য যাওয়া শুরু করেন ঝুলন।

ঝুলন বলেন, ‘খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ট্রেনে করে গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে প্রশিক্ষণ শেষে আবার ট্রেন ধরে গ্রামে স্কুলে ঢুকতাম। আমার বোলিং ও উচ্চতা দেখে সেখানকার কোচ আমাকে আমার বোলিংয়ের দিকে মনোনিবেশ করতে বলেন।

স্বপ্না সাধু একটি কোচিং সেন্টার চালাতেন। পাতলা এবং লম্বা ঝুলন তখন তার কাছে গিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ‘ঝুলনের ক্রিকেট খেলা নিয়ে গ্রামবাসী ও ঝুলনের পরিবার খুশি ছিল না। ধীরে ধীরে ঝুলন অ্যাকাডেমিতে আসা বন্ধ করে দেন। ওর সামর্থ্য দেখে ঝুলনের গ্রামে গিয়ে সবাইকে বুঝিয়েছি ঝুলনকে খেলতে দিতে। বাকিটা আপনার সামনেই আছে’।

আজ ঝুলন বিশ্বের অন্যতম দ্রুততম বোলার। ২০০২ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলা ঝুলন ভারতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।

সিনিয়র ক্রিকেট সাংবাদিক আয়াজ মেমন বলছেন, ঝুলন যে ধরনের সাফল্য পেয়েছেন, তা তখনই সম্ভব, যখন কেউ কোনো রকম বিঘ্ন ছাড়াই খেলতে থাকে, শুধু খেলার দিকে মনোনিবেশ করে এবং খেলা চালিয়ে যায়।

ঝুলনের কেরিয়ারের দিকে তাকালে দেখা যাবে, নতুন রেকর্ড তৈরি করাটা ঝুলনের অভ্যাসের মতো ছিল। মহিলাদের ওয়ান ডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েছেন ঝুলন। আইসিসি র্যাংঙ্কিংয়ে তিনি বোলিংয়ে এক নম্বর হয়েছেন।

২০০৭ সালে আইসিসি বর্ষসেরা মহিলা খেলোয়াড় হয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন ঝুলন। প্রথম ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে এই নজির গড়েন তিনি।

তিনি বলেন, ‘পুরুষদের ক্যাটাগরিতে ভারতের কোনো মনোনয়ন ছিল না। তাই এই জয় আমার কাছে আরও স্পেশাল। মহিলা ক্রিকেটের জন্য এই পুরস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধীরে ধীরে বাড়ছে মেয়েদের ক্রিকেট। আমরা গণমাধ্যমে কাভারেজ পেতে শুরু করেছি। এটি ক্রিকেটে আরও মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যাবে।’

ঝুলন বলছেন, যখনই তিনি কলকাতার বিবেকানন্দ পার্কে যান, যেখানে তিনি খেলতেন, সেখানে এখন অনেক মেয়েকেই ক্রিকেট খেলতে দেখা যায়, কেউ কেউ এতটাই ছোট যে, তাঁদের কিটব্যাগও তুলতে পারেন না।

ঝুলন সমাজের এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন। তার মতো অনেক মেয়েকে সমাজ এবং পরিবারের বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

ভারতের মহিলা ক্রিকেট দলের কোচ ডব্লিউভি রমনের সঙ্গে ইউটিউবের বিশেষ চ্যাটে ঝুলন তার গল্প বলেছেন, ‘মহিলা ক্রিকেট সংস্থার কাছে খুব কম টাকা ছিল। মেয়েরা ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্য ট্রেনে যাতায়াত করত। কখনও কখনও কোনও রিজার্ভেশন থাকত না এবং তাদের সাথে বড় কিট ব্যাগ থাকত। যে মাঠে আমরা খেলেছি, সেগুলোও ভালো ছিল না।

“আপনি যদি বিমান ভ্রমণের জন্য টিকিট পান তবে আপনাকে অতিরিক্ত লাগেজ বা লাগেজের জন্য অর্থ প্রদান করতে হবে। ব্যাগের ওজন কমানোর জন্য আমরা শুধু মাঠে যে পোশাক পরতাম, তা-ই রাখতাম। পরার জন্য কোনও ভাল জুতা ছিল না এবং আমরা জুগাদের সাথে কাজ করতাম। দিল্লিতে তখন অনেক ক্রিকেটারকে সাহায্য করতেন তারক সিনহা। সেই সময় আশিস নেহরার কাছ থেকে জুতো নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে তার জুতো আমাকে দিয়েছিল, যাতে আমরা ম্যাচটা খেলতে পারি।

এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে এবং এই প্রেক্ষাপটে ঝুলনের মতো মহিলা ক্রিকেটারদের অবদান আলাদা তাৎপর্য বহন করে।

শুধু ঝুলনের সতীর্থরাই নন, ঝুলনকে লোহা ভেবেছিলেন তাঁর প্রতিপক্ষরাও। সানা মীর, যিনি পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক ছিলেন, তিনি ভারতের বিরুদ্ধে অনেক ম্যাচ খেলেছেন এবং ঝুলনের মুখোমুখি হয়েছেন।

ফাস্ট বোলার হিসেবে আমরা তাকে কখনো ব্যাটসম্যানের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে দেখিনি। মাঠে ওর আচরণ খুব শালীন ছিল। বিশ বছরের কেরিয়ারের জন্য এটি একটি ছোট জিনিস নয়। তার গতি এবং উচ্চতা এতটাই ছিল যে, ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি ঝুলন যখন বোলিং করতো, তখন আমরা ঘামতাম। আমাদের ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয়েছিল যে ঝুলন বলটি নিক্ষেপ করছে। ঝুলনের বিরুদ্ধে আমরা কীভাবে ব্যাট করতাম তা আমরাই কেবল জানি,” ঝুলনের প্রশংসা করে হেসে ফেলেন সানা।

ঝুলনের ছোটবেলার কোচ স্বপন সাধু বলেছেন, ফিটনেস এবং খেলার প্রতি আনুগত্য ঝুলনকে আলাদা করে তুলেছে।

ক্রীড়া সাংবাদিক আদেশ কুমার গুপ্তা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলনের ম্যাচ কভার করেছেন।

তিনি বলেন, ‘২০০২ সালে ঝুলন যখন দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তখন খুব কম ভারতীয়ই মহিলা ক্রিকেট অনুসরণ করতেন। ডায়না এডুলজি এবং শান্তা রাঙ্গাস্বামীর মতো কয়েকজন নির্বাচিত মহিলা ক্রিকেটারের নাম মানুষ জানত। আর বোলারদের কথা যদি বলেন, তাহলে অনেক শক্তিশালী ভারতীয় পুরুষ খেলোয়াড়ের নাম গুনতে পারেন। কিন্তু আমরা যদি ভারতীয় মহিলা ফাস্ট বোলারদের কথা বলি, তাহলে ঝুলনের মতো কয়টি নাম গণনা করা যেতে পারে?

“ওয়ানডেতে সে ২৫০-র বেশি উইকেট নিয়েছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে ঝুলন মাত্র ১২ টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন এবং ৪৪ টি উইকেট নিয়েছেন কারণ মহিলা ক্রিকেটাররা টেস্ট খেলতে পারছেন না। আমার মনে আছে, আমি যখন দিল্লির ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে যেতাম, তখন খুব কম মেয়েই ছিল। আজকের দৃশ্যটা ভিন্ন। ঝুলনের মতো খেলোয়াড়দের এটাই আসল প্রাপ্তি।

কয়েক মাস আগে, ঝুলনকে ইডেন গার্ডেন্সে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল যাতে তিনি আইপিএল এলিমিনেটর ম্যাচগুলির জন্য ঐতিহ্যবাহী বেল-বাজানো অনুষ্ঠান করতে পারেন। এটি সেই একই মাঠ যেখানে ১৯৯৭ সালের বিশ্বকাপে ১৫ বছর বয়সী ঝুলন বল গার্ল হিসেবে কাজ করেছিল। আর ২০০২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা ঝুলন লর্ডসের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই শেষ ম্যাচ খেলে ক্রিকেটকে বিদায় জানান।

ঝুলন এমন একজন খেলোয়াড় যিনি তার সতীর্থ, প্রতিপক্ষ এবং ভক্তদের সম্মান পেয়েছেন। মনে পড়ে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রিকেট ম্যাচের কথা। কী ভাবে ঝুলন ভারতকে প্রায় জিতিয়েই দিয়েছিলেন! কিন্তু বৃষ্টির জন্য সেই ম্যাচ বন্ধ করে পাকিস্তানকে বিজয়ী ঘোষণা করতে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *