বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি এক জটিল এবং পরিবর্তনশীল আবর্তের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে যেমন গ্লোবালাইজেশন এবং আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে বাড়ছে আঞ্চলিক সংঘাত, পরাশক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা। এই প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন প্রায়শই উঠে আসে – বর্তমান বিশ্বে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা কতটা প্রবল? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করে একটি বিশদ চিত্র পাওয়া যেতে পারে।

প্রথমত, বিশ্বযুদ্ধের সংজ্ঞা এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
বিশ্লেষণের শুরুতে, আমাদের “বিশ্বযুদ্ধ” শব্দটির অর্থ বোঝা প্রয়োজন। সাধারণভাবে, বিশ্বযুদ্ধ বলতে এমন একটি বৃহৎ আকারের আন্তর্জাতিক সংঘাতকে বোঝায় যেখানে বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে এবং যা ভৌগোলিকভাবে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। বিংশ শতাব্দীতে আমরা দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ দেখেছি, যার মূল কারণ ছিল সাম্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ, ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এবং ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়নে সাহায্য করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং সংঘাতের উৎস:
বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যা সংঘাতের জন্ম দিতে পারে:
পরাশক্তির প্রতিযোগিতা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার তীব্র প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতা বিভিন্ন আঞ্চলিক সংঘাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও কঠিন করে তুলছে।
আঞ্চলিক সংঘাত: ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের জাতিগত ও রাজনৈতিক সংঘাত – এই সমস্ত আঞ্চলিক সংকট বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি স্বরূপ। এদের মধ্যে যেকোনো একটি বড় পরাশক্তির সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বৃহত্তর সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবনার বিস্তার এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রবণতা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং শান্তির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। জাতীয় স্বার্থের নামে অন্য দেশের প্রতি অসহিষ্ণুতা এবং আগ্রাসী মনোভাব বাড়ছে।
অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং বৈষম্য: বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্য সামাজিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে এবং জাতীয়তাবাদী আবেগকে উস্কে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা অনেক সময় রাজনৈতিক সংঘাতের রূপ নেয়
প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং সামরিকীকরণ: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার যুদ্ধ এবং মহাকাশ প্রযুক্তির মতো অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তির উন্নয়ন নতুন ধরনের সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। বিভিন্ন দেশ তাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, যা একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট খাদ্য ও জলের অভাব এবং প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা ভবিষ্যতে নতুন সংঘাতের কারণ হতে পারে।
তৃতীয়ত, বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার মাত্রা:
উপরের কারণগুলো বিবেচনা করলে, বর্তমান বিশ্বে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে, কিছু বিষয় এই আশঙ্কাকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে পারে:
পারমাণবিক অস্ত্রের উপস্থিতি: পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপক ধ্বংস ক্ষমতা প্রধান শক্তিগুলোকে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। পারস্পরিক নিশ্চিত ধ্বংসের ভয় (Mutually Assured Destruction – MAD) একটি শক্তিশালী প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে।
আন্তঃনির্ভরশীল অর্থনীতি: বর্তমান বিশ্বে দেশগুলোর অর্থনীতি একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত। একটি বৃহৎ আকারের যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করবে, যা কোনো দেশের জন্যই কাম্য নয়। অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরশীলতা সংঘাতের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং কূটনীতি: জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সংঘাত নিরসনে এবং শান্তিরক্ষার জন্য কাজ করে চলেছে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং আলোচনার মাধ্যমে অনেক সংকট সমাধান করা সম্ভব।
জনমতের প্রভাব: বিশ্বব্যাপী শান্তিপ্রিয় মানুষের সংখ্যা এখনও অনেক বেশি। যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা এবং শান্তির পক্ষে জনমত বিশ্বনেতাদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
চতুর্থত, সম্ভাব্য বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট:
যদি আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়, তবে তার প্রেক্ষাপট গত দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে ভিন্ন হতে পারে। সরাসরি বৃহৎ আকারের স্থলযুদ্ধের পরিবর্তে সাইবার আক্রমণ, মহাকাশে সামরিক সংঘাত এবং আঞ্চলিক সংঘাতের বিস্তার লাভ করার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়াও, তথ্য যুদ্ধ এবং অপপ্রচার জনমতকে প্রভাবিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
পঞ্চমত, ঝুঁকি হ্রাস করার উপায়:
বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা হয়তো সম্ভব নয়, তবে কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যেতে পারে:
কূটনৈতিক আলোচনা এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি: বিভিন্ন দেশের মধ্যে নিয়মিত এবং ফলপ্রসূ কূটনৈতিক আলোচনা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক আইন এবং নীতি জোরদার করা: আন্তর্জাতিক আইন এবং নীতি মেনে চলার জন্য সকল দেশকে উৎসাহিত করা এবং যারা লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ: পারমাণবিক এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।
অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস এবং স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি: বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং অসহিষ্ণুতার মোকাবিলা: শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং অন্য দেশের প্রতি অসহিষ্ণুতা মোকাবিলা করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার: জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সংঘাতের উৎসগুলো প্রশমিত করতে হবে।
বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি নিঃসন্দেহে একটি সংকটপূর্ণ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পরাশক্তির প্রতিযোগিতা, আঞ্চলিক সংঘাত এবং জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা বিশ্ব শান্তির জন্য একটি বড় হুমকি। তবে, পারমাণবিক অস্ত্রের উপস্থিতি, অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরশীলতা এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা, বিচক্ষণ নেতৃত্ব এবং শান্তির প্রতি অবিচল অঙ্গীকার। বিশ্বনেতাদের দায়িত্ব হলো সংঘাতের উৎসগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধানে আন্তরিকভাবে কাজ করা, যাতে মানবজাতি আরেকটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পায়।