ভুল গ্রুপের রক্তদান: জীবনঘাতী ঝুঁকি ও জনসচেতনতা সৃষ্টির অপরিহার্যতা

রক্তদান একটি মহৎ কাজ, যা মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে। তবে, এই প্রক্রিয়ার সামান্যতম ভুলও ভয়াবহ পরিণতির কারণ হতে পারে, বিশেষ করে যখন ভুল গ্রুপের রক্ত রোগীর শরীরে প্রবেশ করে। ভুল গ্রুপের রক্তদানের ফলে রোগীর শরীরে যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, তাকে বলা হয় অ্যাকিউট হিমোলাইটিক ট্রান্সফিউশন রিঅ্যাকশন (AHTR)। এটি একটি জীবনঘাতী অবস্থা যা দ্রুত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি সাধন করে এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।

ভুল গ্রুপের রক্ত শরীরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই রোগীর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং দান করা রক্তকে “বিদেশী” হিসেবে চিহ্নিত করে আক্রমণ করে। এর ফলে দান করা লোহিত রক্তকণিকাগুলো ভেঙে যায়, যাকে বলা হয় হিমোলাইসিস। এই প্রক্রিয়ায় হিমোগ্লোবিন রক্তপ্রবাহে মুক্ত হয়, যা কিডনির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে তীব্র জ্বর, কাঁপুনি, পিঠে ব্যথা, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, নিম্ন রক্তচাপ এবং প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া। সময়ের সাথে সাথে, রোগীর কিডনি বিকল হতে পারে, রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে, যা মাল্টিপল অর্গান ফেইলিউরের দিকে নিয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে, ভুল গ্রুপের রক্তদানের প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা এতটাই বেশি হতে পারে যে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রোগীর মৃত্যু ঘটে।


এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। প্রথমত, রক্তদানের আগে রক্তের গ্রুপ সঠিকভাবে নির্ণয় করা হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধুমাত্র রেজিস্টার্ড ব্লাড ব্যাংক এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারাই এই পরীক্ষা করানো উচিত।

প্রতিটি রক্তদান কেন্দ্রে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষিত কর্মী থাকা আবশ্যক, যাতে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ে কোনো ভুল না হয়। দ্বিতীয়ত, রক্তদাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে রক্তের গ্রুপ সঠিকভাবে মিলছে কিনা, তা একাধিকবার পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা উচিত। এটিকে ক্রস-ম্যাচিং বলা হয়, যা রক্ত সঞ্চালনের আগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ।

তৃতীয়ত, রক্তদান সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে হবে। ভুল গ্রুপের রক্তদানের বিপদ সম্পর্কে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান এবং প্রচারণা চালানো জরুরি। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্বাস্থ্য ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কার্যক্রম আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে তরুণ প্রজন্মকে রক্তদানের সঠিক পদ্ধতি এবং এর ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত করা হবে।

চতুর্থত, রক্তদানের সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। যেকোনো সন্দেহ বা অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সর্বশেষে, রক্তদানের গুরুত্ব যেমন প্রচার করা হয়, তেমনি ভুল গ্রুপের রক্তদানের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কেও মানুষকে সচেতন করতে হবে, যাতে প্রতিটি রক্তদান নির্ভুল ও নিরাপদ হয় এবং তা সত্যিই একটি জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে।