গৌতম আদানিকে নিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যমে অনেক কথাই বলা হচ্ছে, ট্রাম্প কী করবেন?

ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি এই গ্রীষ্মে আদানির সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিদর্শন করেছেন। গারসেটি আদানিকে দেখার পরে তাকে অনুপ্রেরণামূলক ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন

বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানির জন্য বৃহস্পতিবার দিনটি ছিল খুব একটা ভালো ছিল না।

তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ঘুষ ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে। আদানির বিরুদ্ধে তার একটি কোম্পানির কাজ পেতে ২৫ কোটি ডলার ঘুষ দেওয়া এবং মামলা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার ভোরে এ খবর প্রকাশ্যে আসতেই তা কাভারেজ করে দেয় বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে। ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও গৌতম আদানিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ এনেছে। শেয়ার বাজার খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলির শেয়ারের দাম পড়ে যায় ২০ শতাংশ।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার গৌতম আদানির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ গঠনের পর তার মোট সম্পদের পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে।

বাজার বন্ধের সময় তার মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালের শেষে ছিল ৮৪ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ৩ জুন পর্যন্ত তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যদিও বৃহস্পতিবার বিকেলে আদানি গোষ্ঠীর তরফে বিবৃতি দিয়ে এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানানো হয়েছে, সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন।

বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে আদানি গ্রুপ বলেছে, ‘আদানি গ্রিনের পরিচালকদের বিরুদ্ধে মার্কিন বিচার বিভাগ এবং এক্সচেঞ্জ কমিশন যে অভিযোগ করেছে তা ভিত্তিহীন এবং আমরা তা প্রত্যাখ্যান করছি।

আদানির প্রকল্প নিয়ে কেনিয়াতেও ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রে অভিযোগ এবং ব্যাপক প্রভাব

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের প্রভাব শেয়ার বাজারে তাদের সংস্থাগুলির দুর্দশার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট হঠাৎ জানান, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও জ্বালানি চুক্তির জন্য ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির সঙ্গে করা বিলিয়ন ডলারের চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন, তার তদন্তকারী সংস্থা ও অংশীদার দেশগুলোর তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করেননি। আদানি গ্রুপ কেনিয়ার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়াধীন ছিল। এর অধীনে, কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির প্রধান বিমানবন্দরটি সম্প্রসারণ করা হবে, নতুন রানওয়ে এবং টার্মিনাল নির্মিত হবে। বিনিময়ে আদানিকে ৩০ বছরের জন্য নাইরোবি বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হতো।

কেনিয়াতেও আদানির সঙ্গে এই চুক্তি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল এবং বিমানবন্দরের কর্মীরা আন্দোলন করছিলেন। বিমানবন্দর কর্মীরা জানিয়েছেন, আদানি বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব পেলে চাকরির অবস্থার পরিবর্তন হবে এবং তাদের চাকরিও চলে যেতে পারে।

আদানির এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী ব্লুমবার্গকে বলেন, ‘বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। আদানির গ্রিন এনার্জি ব্যবসা বন্ড বিক্রির মাধ্যমে ৬০ কোটি ডলার সংগ্রহ করেছে। বৃহস্পতিবার ভোর তিনটে নাগাদ তাঁর এক সহকর্মী তাঁকে এই দুঃসংবাদটি দেন। ওই সহকর্মী জানান, যুক্তরাষ্ট্রে তার ও তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়াতেও আদানির এই প্রকল্পের বিরোধিতা করা হয়েছে
ক্ষতি ১৫ বিলিয়ন ডলার

ব্লুমবার্গের মতে,কয়েক মিনিটের মধ্যে, আদানি গ্রুপের সিনিয়র এক্সিকিউটিভরা কনফারেন্স কলে এসেছিলেন। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল প্রসিকিউটররা অভিযোগ করেছেন যে আদানি এবং তার সহকর্মীরা মার্কিন বিনিয়োগকারীদের ঘুষ বিরোধী নিয়ম সম্পর্কে মিথ্যা বলেছিলেন কারণ তারা ভারতীয় কর্মকর্তাদের ২৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঘুষ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

সকালে বাকি ভারত যখন ঘুম থেকে উঠল, ততক্ষণে আদানি পুরো বিতর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিল। মুম্বাইয়ে শেয়ার বাজার খুলতেই আদানি গ্রুপের শেয়ারের পতন শুরু হয়। দুপুরের মধ্যে আদানি গ্রুপ একটি বিবৃতি জারি করে এবং সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে। গোটা ঘটনায় আইনি পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছে আদানি গোষ্ঠী।

ব্লুমবার্গ লিখেছে, আগামী মাসগুলোতে আদানিকে নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক বাড়তে পারে। প্রত্যর্পণ নিয়ে উত্তেজনা থাকবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প শীঘ্রই আমেরিকার কমান্ড নিতে চলেছেন এবং তিনি চাইলে ভারতের মোকাবিলা করতে পারেন।

ট্রাম্পের মতে, চীনের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে ভারত ও আদানি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্রে জানা গেছে, ট্রাম্পের পরিবারের সদস্যরা আহমেদাবাদে আদানির বাসভবনেও গিয়েছেন। এ ধরনের মামলায় কয়েক বছর না হলেও কয়েক মাস লেগে যাবে এবং তাদের অবস্থান কী হবে তা ট্রাম্পের বিচার বিভাগকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ব্লুমবার্গ লিখেছে, আদানিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটছে তার প্রভাব শুধু এই গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এর প্রভাব পড়বে ঋণ প্রদানকারী বৈশ্বিক ব্যাংকগুলোর ওপরও। এর পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলো যারা বিদেশে পা রাখতে চায়, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ব্লুমবার্গের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ভারত ও উদীয়মান এশিয়া অর্থনীতির প্রধান রিক রোসো বলেন, আমি আশঙ্কা করছি যে এটি আদানির বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণে প্রভাব ফেলবে। এই মামলা ভারতে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলতে পারে যে আমেরিকা এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো উদীয়মান ভারতকে ধীর করতে চায়।

কী প্রভাব পড়বে ভারতে?
গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারী এবং ব্যাংকগুলো আদানি গ্রুপে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢেলেছে । আজ আদানির ব্যবসা বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত। আদানির প্রকল্পগুলো ভিয়েতনাম থেকে ইসরায়েল পর্যন্ত বিস্তৃত। আদানি গ্রুপের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডের সমান্তরালে ভারতের প্রক্সি হিসাবে দেখা হয়।

একই সঙ্গে বিখ্যাত মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, আদানি কোনও সাধারণ ভারতীয় বিলিয়নিয়ার নন। আদানিকে ভারত সরকারের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে দেখা হয়। আদানি গ্রুপ বন্দর তৈরি করে কিনে নেয়। এটা প্রায়ই ভারত সরকারের চুক্তি বা লাইসেন্সের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক এবং বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্বেও রয়েছে। এখন আদানি একটি টিভি নিউজ চ্যানেলেরও মালিক। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আদানির ব্যবসা ভারতের কেন্দ্রে চলে আসে। প্রধানমন্ত্রী মোদী যেভাবে ভারতকে বিশ্বমঞ্চের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছিলেন, আদানিও সেই কেন্দ্রে চলে এসেছিল।

নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি এই গ্রীষ্মে আদানির সৌর শক্তি প্রকল্প দেখতে গিয়েছিলেন। গারসেটি আদানিকে দেখার পরে তাকে অনুপ্রেরণামূলক ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।

মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, গৌতম আদানিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। উভয় সফরের সময় আদানি গ্রুপ ব্যবসায়িক চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। শ্রীলঙ্কা থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে এসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আদানি ভারতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর শক্তি এবং উত্পাদন নীতি অনুসরণ করে এবং এটি তাকে রাজনীতি মোকাবেলায় সহায়তা করে। আদানির ব্যবসায়িক সাফল্যকে ভারতে একটি ক্রমবর্ধমান পয়েন্ট হিসাবে দেখা হচ্ছে।

ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, ‘আমেরিকায় আদানির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভারত ও আমেরিকার সম্পর্ককে জটিল করে তুলতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের অভ্যন্তরে অনেক সমালোচনার মুখে পড়েছে আদানি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে। যখনই আদানি বিপদে পড়েন, বিজেপি তার সাথে যোগ দেয় এবং যারা আদানির সমালোচনা করে তাদের ভারতের শত্রু বলে অভিহিত করে।

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া কর্মসূচির পরিচালক মিলন বৈষ্ণব ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘বাইডেন প্রশাসন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও উচ্চতর স্তরে নিয়ে যাওয়ার আশা করছিল। এটা স্পষ্ট যে এই ঘটনা নিশ্চয়ই মোদীর পছন্দ হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *